স্বদেশ ডেস্ক:
বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে দফায় দফায় চিনির দাম বাড়িয়ে চলেছেন ব্যবসায়ীরা। বাজার নিয়ন্ত্রণে ন্যায্যতা যাচাই-বাছাই করে সরকার কয়েক দফায় পণ্যটির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু তা উপেক্ষা করে বাজারে বেশি দামেই বিক্রি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে গতকাল ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আবারও চিনির দাম বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে। অথচ বাজারে আগে থেকেই এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে চিনির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। নতুন এ ঘোষণায় খোলা চিনির দাম প্রতিকেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। অথচ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা দোকান ঘুরে দেখা গেছে, গত এক মাস ধরে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১১০ টাকা। পাড়া-মহল্লার কোথাও কোথাও আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ পরিশোধনকারীরা নতুন করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও বাজারে আগে থেকেই অন্তত ৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এখন নতুন এ ঘোষণার পর কোন দামে চিনি বিক্রি হবে তা জানেন না খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা। অন্যদিকে চিনির দাম নিয়ে ক্ষুব্ধ ভোক্তারাও।
রাজধানীর সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হক বলেন, খবরে শুনি এই দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, ওই দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজারে গিয়ে তো কিনতে হয় বেশি দামেই। বাজারে যা খুশি চলছে। আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।
রাজধানীর মালিবাগ বাজারের বিপ্লব স্টোরের ব্যবসায়ী মো. সোলায়মান বলেন, পাইকারিতে চিনির বস্তা (৫০ কেজি) এখন কিনতে হচ্ছে ৫ হাজার ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। অর্থাৎ কেনা দাম পড়ছে ১০৬ থেকে ১০৭ টাকা। খুচরায় তা ১১০ টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে। এ দাম তো নির্ধারিত ঘোষণার নতুন দামের চেয়েও বেশি।
তিনি আরও বলেন, নতুন করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী ১০৭ টাকায় বিক্রি করতে পারব কিনা, নাকি আরও বাড়বে নাকি ১১০ টাকাই থাকবে তা বলা মুশকিল। পাইকারিতে যে দামে কিনতে হবে, সে দামেই বিক্রি করতে হবে আমাদের। এখন নির্ধারিত দাম ও বাজারের দামের ব্যবধান অনেক বেড়ে গেলে প্যাকেট চিনির মতো খোলা চিনির বিক্রিও বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ চিনি কিনতে গেলে রশিদ পাওয়া যায় না। বাজারে অভিযান হলে বিপদে পড়তে হয় আমাদের।
একই কথা জানালেন কদমতলী সাদ্দাম মার্কেটের মিলন স্টোরের বিক্রেতা মো. মিলন হোসেনও। তিনিও বলেন, পাইকারিতে চিনির দাম এমনিতেই বাড়তি। প্রতিবস্তা ৫ হাজার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত কিনতে হচ্ছে, যা খুচরায় ১১০ টাকায় বিক্রি করেছি। দাম বাড়ানোর নতুন ঘোষণায় যে দাম বলা হয়েছে, তার থেকে তো এখনই বেশি। তা হলে কি আরও বাড়বে? কারণ এক মাস আগেও তো চিনি ১১৫ টাকা বিক্রি করেছি। যদিও তখন আলাদা করে দাম বাড়ানো হয়নি। আসলে চিনির বাজারে কী হচ্ছে বোঝা মুশকিল।
পাইকারি পর্যায়ে ভোগ্যপণ্য বিক্রেতাদের সংগঠন মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, গ্যাস সংকটের অজুহাত দিয়ে কোম্পানিগুলো এমনিতেই সরবরাহ কম করছে। অন্যদিকে দাম বাড়তি রয়েছে। আমাদের ক্রয় রশিদ দেওয়া হলেও রশিদে এক দাম থাকে আর কিনতে হয় আরেক দামে। বাড়তি দামে কিনলে কমে বিক্রির সুযোগ তো নেই। আমরা তো ব্যবসা করি। লোকসান দিয়ে তো পণ্য বিক্রি করা যাবে না।
এদিকে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের বাজার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর খুচরাবাজারে খোলা চিনি বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। গত মাসে বিক্রি হয় ১১০ থেকে ১১৫ টাকা এবং এক বছর আগে বিক্রি হয় ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা পর্যন্ত। এক মাসে ২ দশমিক ২২ শতাংশ এবং এক বছরে ৫০ শতাংশেরও বেশি দাম বেড়েছে।
ভোক্তাস্বার্থ নিয়ে কাজ করছে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সংগঠনটির সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বাজারে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দাম, রশিদবিহীন পণ্য ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া, পণ্যের কৃত্রিম সংকট এ রকম নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা অসাধু ব্যবসায়ীরা তৈরি করছে। মূলত পণ্যের দাম বাড়াতেই তারা বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। সামনে রমজান মাস, এ কারণেও হয়তো চিনির বাজারে এমন হচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এটি কাম্য নয়। মূল্যস্ফীতির চেয়ে ‘লোভস্ফীতি’ আমাদের বড় সমস্যা। একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের লোভ এত বেড়েছে যে তাদের নৈতিকতা বিলুপ্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চিনির সরবরাহে সরকারের নজর থাকতে হবে। মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই দিশাহারা মানুষ। আসন্ন রমজান মাস কেন্দ্র করে পণ্যের দাম যাতে অযৌক্তিকভাবে বাড়তে না পারে, সেদিকে দেখতে হবে। প্রয়োজন হলে শুল্ক ছাড় দিয়ে হলেও সরকারকে চিনিসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণের নাগালে রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, অপরিশোধিত চিনির আন্তর্জাতিক বাজারদর বৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও স্থানীয় পরিশোধনকারী মিলগুলোর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে সর্বশেষ গত বছরের ১৭ নভেম্বর খুচরা পর্যায়ে চিনির দাম বাড়ান হয়েছিল। সেবার খোলা চিনির দাম ১০২ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। বাজারে বাড়তি দামে খোলা চিনি পাওয়া গেলেও বাজারে এখনো প্যাকেটজাত চিনি প্রায় উধাও। বেশিরভাগ দোকানে ১০৭ টাকা মূল্যের প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন দাম অনুযায়ী ১১২ টাকা কেজির প্যাকেট চিনি বাজারে পাওয়া যাবে কিনা সে তথ্য জানা যায়নি।